ব্রয়লারের ১২ থেকে ১৮ দিন বয়স (ক্রিটিক্যাল সময়)--ব্রয়লার মুরগী জন্মের দিন থেকে ৩০ দিন বয়সের মধ্যে যে পরিমান ওজন লাভ করে তা এই দুনিয়ার আর কোন প্রানী পক্ষে সম্ভব নয়।
অথচ মাত্র ৪৫-৫০ গ্রামের একটি ব্রয়লার বাচ্চা ৩০ দিনে ১৬০০ গ্রাম ওজন লাভ করে। যা তার জন্মের ওজনের ৩২০০%!! ভেবে দেখুন বিষয়টা। বার তলা একটা বিল্ডিং বানানোর জন্য যেমন একটা শক্ত ফ্রেম দরকার যা উক্ত বিল্ডিঙের সব ওজন বহন করবে, নির্মান করতে হবে প্রযোজন অনুসারে সঠিক মাপের কলাম ও ভীম। অন্যথায় ভবনটি কখনোই মজবুত হবে না যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে।
তেমনি ভাবে ১৬০০ গ্রাম ওজন বহনের জন্য ব্রয়লার মুরগীর দরকার শক্ত ও বড় স্কেলিটাল বা হাঁড়গোড়। ব্রয়লার মুরগীর অস্তিতন্ত্র মানে হাড্ডি বাড়ে মূলত ১২-১৮ দিন বয়সের মধ্যে। এই সময়ে নির্ধারন হয়ে যায় কোন মুরগীটা কতটুকু বড় হবে ,লম্বা গঠনের মুরগী বেশী মাংসের ওজন বহন করতে পারবে আর ছোট সাইজের অস্তিতন্ত্র কম মাংসের ওজন বহন করতে পারবে।
সুতরাং আমাদের বড় সাইজের ব্রয়লার মুরগী পেতে হলে যা করার এই সাত দিনের মধ্যেই করতে হবে। এই বয়সের খাদ্যে খনিজ পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম,ফস্ফরাস,জিংক,ম্যাগনেশিয়াম আয়রন ইত্যাদির আধিক্য থাকতে হবে পাশাপাশি ভিটামিন ডি,এ খাদ্যের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমানে থাকা বাঞ্চনীয়।
যেহেতু প্রায় সকল ব্রয়লার খামারী বিভিন্ন কোম্পানীর রেডি খাদ্য খাওয়ান তাই তাদের পক্ষে অনুমান করা বাস্তবেই কঠিন খাদ্যে কি পরিমাণে এই সময়ের জন্য দরকারি মিনারেল বা ভিটামিন আছে। ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এই ১২-১৮ দিন বয়সের ব্রয়লার মুরগীর খাবার পানির সাথে মিনারেল ও ভিটামিন যেগুলো হাড়ের গঠন এবং দ্রুত বাড়তে সাহায্য করে তা এই সাত দিন পর্যন্ত প্রতিদিন উৎপাদনকারীর নির্দেশনা অনুসারে ব্যবহার করতে হবে।
এই বয়সে যদি সঠিক পরিমানে ভিটামিন ও মিনারেল মুরগীর রক্তে না থাকে তাহলে চূড়ান্ত ভাবে ভাল ওজন ও বড় সাইজের ব্রয়লার আশা করা যায় না।ব্রয়লারের ২৪ থেকে ২৮ দিন বয়স(দ্রুত মাংস বাড়ার সময়)ঃভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন; ২৪ দিন বয়সের আগে যদি মুরগী কোনভাবে রোগব্যাধি বা অন্যান্ন ব্যাবস্থাপনা বিষয়ে মারাত্মক ভুক্তভুগি না হয় তাহলে ২৪-২৮ দিন বয়সে প্রতিদিন ১০০-১২০ গ্রাম হারে দৈহিক ওজন লাভ করছে।
এটা সম্ভব যদি খাদ্যে দরকারি পুস্টি ঊপাদন থাকে এবং সঠিক মাপের অস্তিতন্ত্র গঠিত হয়। ব্রয়লারের জীবনের এই ৫ দিন দেহ দ্রুত বাড়ার কারনে মুরগীর মেটাবলিক রেট( বিপাকীয় হার) অনেক বেড়ে যায়। যার কারণে মুরগির শরীর থেকে আগে তুলনায় অনেক বেশি তাপমাত্রা বের হয় এবং মুরগীর গরমজনিত কারনে মৃত্যু হতে পারে।
অন্যদিকে রক্ত সংবহনতন্ত্র(রক্তনালী হার্ট ফুসফুস) যদি অতিরিক্ত রক্ত বহনের উপযোগী না থাকে তাহলে অতিরিক্ত ওজনের জন্য ব্রয়লার মুরগী হার্টফেল করতে পারে।উল্লেখিত বয়সে এই সকল সমস্যা এড়ানোর জন্য ঘর খোলামেলা রাখতে হবে,গরমের সময় ফ্যানের ব্যবস্থা থাকতে হবে, লিটার যতটা সম্ভব শুকনা রাখার চেস্টা করতে হবে।
মুরগীর অধিক ঘনত্ব পরিহার করতে হবে। গরমজনিত ধকল ,হার্টস্টোক এড়ানোর জন্য ২৪-২৮ বয়সে পানিতে ইলেক্ট্রোলাইট,ভিটামিন ই এবং সি ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যুতসই ভ্যাকসিন প্রয়োগ; রোগ প্রতিরোধ এবং ভ্যাক্সিনেশনঃ যুতসই ভ্যাকসিন প্রয়োগঃ রোগ না আসলেও ভ্যাক্সিন দিতে হয় কারন আমরা মুলত ভাইরাস জনিত রোগ প্রতিরোধ করার জন্যই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করি।
ভাইরাস জনিত রোগে একবার যদি খামার আক্রান্ত করে তেমন কিছু করার থাকে না। কারন ভাইরাস জনিত রোগের কোন চিকিৎসা নাই। প্রশ্ন আসতে পারে আমরা তো গামবোরো বা রানিক্ষেত রোগে আক্রান্ত হলেও এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করি, আসলে ব্যাপারটা তা নয়, এই সকল ভাইরাস জনিত রোগে মুরগি আক্রান্ত হলে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়,এই সুযোগে বিভিন্ন প্রকার ব্যাক্টেরিয়া আক্রমন করে এবং দেহের ভিতরে বাইরে নানা প্রকার ক্ষত,ফুলা পচন সৃষ্টি করে এবং সেকেন্ডারী ইনফেকশান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয় ভাইরাস জনিত রোগের জন্য নয়।
ভাইরাস জনিত রোগ থেকে দূরে থাকতে হলে, দরকার খামারের রোগব্যাধির অবস্থা বিবেচনা করে সঠিক একটি ভ্যাকসিন সিডিঊল বানানো এবং সে মোতাবেক সঠিক বয়সে,সঠিক মাত্রায়,সঠিক নিয়মে মুরগিকে ভ্যাকসিন দেওয়া। ভ্যাকসিন দেওয়ার বা সিডিঊল করার জন্য স্থানীয় ভেটেরিনারি চিকিৎসক বা পোল্ট্রি স্পেশালিস্টের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।ভ্যাকসিন পরিবহন এবং সংরক্ষনে অনেক সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। ব্যবহার করা ভ্যাক্সিনের শিশি বা এম্পুল পুড়িয়ে বা মাটিতে পুতে ফেলতে হবে অন্যথায় এই শিশি থেকেই এই রোগ-জীবানু ছড়িয়ে খামারকে আক্রান্ত করবে।
ভাইরাস জনিত রোগে আক্রান্ত মরা মুরগী যত্রতত্র ফেলে দেওয়া যাবে না এতে সবখানে রোগ ছড়িয়ে পড়ার শতভাগ সম্ভাবনা থাকে। মরা মুরগী গভীর গর্ত করে পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। মাইকোপ্লাজমা প্রতিরোধঃ শীতকালে মাইকোপ্লাজমার প্রকোপ অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। এর কারন অতিরিক্ত ঠান্ডা এবং ঘরের বদ্ধ পরিবেশ ও গাদাগারি করে ব্রুডিং করা।আসলে ত্রিমুখী কারন এখানে কাজ করে;যেমন নিন্ম তাপমাত্রা,অধিক ঘনত্ব এবং ব্যাক্টেরিয়ার আধিক্য চূড়ান্তভাবে যাকে আমরা সি আর ডি বা ক্রনিক রেস্পিরেটোরি ডিজিজ বলি সেই রোগে আক্রান্ত হয়।
এই রোগে মুরগির মরার হার তেমন বেশি না হলেও ক্ষতির পরিমান অনেক বেশি হয়। আক্রান্ত মুরগি খাদ্য খাওয়া পরিহার করে,দিন অনুসারে ওজন বাড়াতে ছন্দ পতন ঘটে,খামারীরা অনেক সময় বুঝে না বুঝে মনগড়া যথেচ্ছ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে। ফলে চিকিৎসায় ভাল হওয়ার বদলে ঔষধের ধকলে মুরগীর দৈহিক ওজন বৃদ্দি থেমে যায়।অথচ ট্রেনের মত সময় ধরে সঠিক সময়ে মুরগী বিক্রি করতে না পারলে লোকসান এড়ানো অসম্ভব।
মাইকোপ্লাজমার জীবানু আমরা চাইলেও পুরোপুরি খামার থেকে বিতাড়িত করতে পারব না। এই জীবানুকে সব সময় মুরগীর দেহে সাবক্লিনিক্যাল লেভেলে রাখতে হবে যা রোগ সৃষ্টির জন্য যে পরিমান জীবাণুর সংখ্যা দরকার সেই সংখ্যায় যেন কখনো যেতে না পারে। রক্তে জীবানুর সংখ্যা কম রাখার জন্য মাইকোপ্লাজমার দমনে একটা উপযুক্ত শিডিউল দরকার। শিডিউলটি পোল্ট্রি কন্সাটেন্টের মতামত নিয়ে করলে ভাল উপকার পাওয়া যাবে।
বায়োসিকিউরিটিঃ সবাই বুঝি, কিন্তু আসল কাজে অবহেলা করি। বায়োসিকিউরিটি মানে জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া, কার নিরাপত্তা দিচ্ছি এক মুরগীর দুই যারা খামারে কাজ করে তাদের এবং যারা খামারের আশেপাশে বাসকরে তাদের। কিভাবে ? নিয়মিত খামারের চারপাশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রেখে,উপযুক্ত জীবানুনাশক ব্যবহার করে, খামারে অনাহুত লোকজন পাখি,ইদুর শেয়াল,বিড়ালের যাতায়ত রোধকরে।
খামারে প্রবেশের আগে গোসল করে পরিস্কার জামা কাপড় পরিধান করে। মুরগীকে পরিস্কার জীবানুমুক্ত পানি খাইয়ে,শুকনা লিটার দিয়ে, বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে,টক্সিন মুক্ত গুনগত খাবার সরবরাহ করে উন্নত মানের বায়োসিকিউরিটির ব্যবস্থা করা যায়। বায়োসিকিউরিটির মুল লক্ষ্য হল কোন ভাবেই যেন বাইর থেকে খামারে ক্ষতিকারক জীবানু প্রবেশ করতে না পারে। তার জন্য যা যা করা দরকার তার সব কাজ প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টা,সপ্তাহে সাতদিন,মাসে ত্রিশ দিন বছরে তিন শত পঁয়ষট্টি দিন ত্রুটিমুক্ত ভাবে করে যেতে হবে।
অন্যথায় লাভজনক ব্রয়লার খামার পরিচালনা করা সুদুর পরাহত হবে। রেডি জীবন্ত ব্রয়লার বিক্রির কৌশলঃ বাস্তবতার কারনে আমাদের দেশে একসাথে একদিনে কোন ব্রয়লার হাউজের মুরগী বিক্রি করা সম্ভব নয়। কমপক্ষে ৩-৪ দিন সময় লেগে যায়। এই সময়ে মুরগীর উপর অনেক ধকল যায় এবং পরিনতিতে যথেষ্ট খাদ্য খেলেও এই সময়ে তেমন ওজন আসে না যা অনেক সময় লোকসানের কারন হয়ে দাঁড়ায়।
ধকল এড়ানোর জন্য ভিটামিন সি এবং ইলেট্রোলাইট বিক্রি কালে সব সময় পানিতে দিয়ে যেতে হবে তাহলে ধকল অনেক কমবে। মনে রাখতে হবে বিক্রির সময় ছোট সাইজের ব্রয়লার ফিমেল/মেয়ে এবং বড় সাইজের ব্রয়লার মেইল/ছেলে।বড় সাইজের গুলো একদিন বেশি থাকলে যে ওজন আসবে ছোটগুলো সে রকম ওজন আসবে না।
তাই বিক্রির শুরুতে ছোট সাইজের গুলো আগে বিক্রি করতে কোন ভুল করবেন না।আজকের দিনে যে মুরগী বিক্রি করবেন বলে স্থির করেছেন তা পাটিশান দিয়ে আলাদা করে নিন,অনাহুত সারা ঘর দাবড়িয়ে মুরগী ধরার চেস্টা করবেন না এতে পরিবহনে মরার হার বেড়ে যাবে এবং অবশিষ্ঠ যে গুলো খামারে অবিক্রীত থেকে যাবে সেগুলোর ওজনের হানি ঘটবে।
Social Plugin